১৯৬।
ফিরোজের সাথে মাঝে মাঝে আলাপ হয়। রাজীব বলেছে সে তার মার সাথে আলাপ
করেছে, এমনি যা শুনেছে তাতে তার অসম্মতি নেই কিন্তু সে একবার মেয়েকে না দেখে
কোন আলাপ করতে রাজী নয়। ভাবী বলেছে মেয়ে বললো
আমার কিছু বলার নেই আপনারা যা ভাল
মনে করেন তাতে আমার আপত্তি নেই। খুকুর মায়েরও একই কথা।
-তাহলেতো রাজীবের মায়ের সাথে মেয়ের দেখা হবার
জন্য ওকে আবার দেশে পাঠাতে হয়।
-হ্যাঁ, তাই ভাবছি। এই মাত্র
দেশ থেকে এসেছে এখনই কি ভাবে সম্ভব? এক দিকে ক্লাসের ব্যাপার তারপরে চাকরীটা
মাত্র পেয়েছে আবার টাকা পয়সার ব্যাপার আছেই, কি করি বলত!
-দেখা যাক আপাতত প্রাইমারি আলাপ হলো কিছু দিন
যেতে দাও তখন দেখব।
-হ্যাঁ ফিরোজ তুমি হাল ছেড়ে দিও
না, ছেলে এবং পরিবার আমার ভাল লেগেছে।
-এ ব্যাপারে তুমি ভেবো না, আমি দেখছি।
১৯৭।
শেষ পর্যন্ত কাজ যখন শেষ হয়ে এসেছে তার আগের দিন অফিসে বস ক্রিসের কাছে
ফোন করে জানিয়ে দিলেন আগামী কাল দুপুরের মধ্যে এখানকার কাজ শেষ হবে এখন কি করবো
বল। ক্রিস বললো ঠিক আছে রাশেদ তুমি অপেক্ষা কর আমি দেখছি কি করব।
সন্ধ্যার পর মর্জিনা আর নাদির দুইজনেই এসে হাজির।
সাথে করে কয়েক প্যাকেট ভরে পোলাও, কাবাব, ভাজা মাছ, মাংস ভুনা
অনেক কিছু নিয়ে এসেছে।
-ভাইয়া, আপনি এখনই খেয়ে নেন, আমি মাত্র
রান্না করেই এনেছি মাইক্রোওয়েভে গরম করলে স্বাদ থাকবে না, বসেন আমার
সামনে বসে খাবেন।
-শোন আমি তো কাল চলে যাচ্ছি।
দুই জনেই চমকে উঠল। -সে কি!
-এখানকার কাজ শেষ। কাল জানাবে এরপর কোথায় যাব।
-কয়েক দিন থাকা যাবে না ভাইয়া?
-না রে, এই না মাত্র লন্ডন থেকে
আসলাম ৪/৫ দিন এখনই আবার ছুটির কথা কি করে বলি?
পরদিন সকালে ক্রিস জানাল।-এন্ডি আগামী
কাল বিকেলে ব্রাউনকে সোয়ান সি নামিয়ে দিয়ে তোমাকে নিয়ে লেস্টার আসবে ওখানে পিটার
আছে তুমি আর পিটার ওখানেই থাকবে ওই তোমার থাকার ব্যবস্থা করবে তুমি এন্ডির সাথে
যোগাযোগ রেখ ও কখন পৌছাতে পারে জেনে নিও।
-আচ্ছা ঠিক আছে ক্রিস।
দুপুরে এন্ডিকে ফোন করে জানলেন সে বিকেল ৫টার মধ্যে আসতে পারে।
সব কিছু গুছিয়ে ৪টার মধ্যেই রেডি হয়ে বসে রইলেন।
কাটায় কাটায় ৫টায় মোবাইল ফোনের সিগন্যাল রিসিভিং
সিস্টেম একটিভেট হলো, চিনতে পারল এন্ডির কল।
-হ্যালো এন্ডি বল
-আরে কি বলবো আমি যে তোমাদের পায়েল লাইবেরির কাছে
এসে ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে গেলাম একটু দেরি হবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে তুমি ধীরে ধীরে আস আমি রেডি হয়ে
আছি।
-এন্ডি বললো রাশেদ তুমি কি করছ?
-তোমার অপেক্ষা করছি।
-ও আচ্ছা, তাহলে জানালার পর্দাটা সরিয়ে একটু
রাস্তার দিকে তাকাতে পারবে?
-হ্যাঁ পারব কিন্তু কি হয়েছে?
-আহা একটু দেখ না!
পর্দা সরিয়ে দেখে এন্ডি তার সবুজ রঙ এর ফোর্ড গাড়ি পার্ক করে গাড়ির
সাথে হেলান দিয়ে উপরে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।
-ও, বুঝেছি ইয়ার্কি করছ?
জানালার পাল্লা খুলে বললেন-
-আগেই যখন এসে পরেছ তাহলে একটু উপরে আস একটা কফি
খেয়ে নিই
-দেরি হয়ে যাবে না?
-দেরি না হয় হলো একটু ট্রেন তো আর মিস করতে হবে
না, আস, সেদিন কার্ডিফ থেকে কফি বিনস এনে গুড়া করে কফি বানিয়ে রেখেছিলাম এখনও
তোমার জন্য যথেষ্ট রয়েছে।
-কি বললে ফ্রেশ গ্রাউন্ড কফি! হ্যাঁ তাইতো বললাম।
-তাহলে আসছি।
রাশেদ সাহেব সাথে সাথে ইলেকট্রিক জগে পানি ভরে সুইচ অন করে নীচে নেমে
দরজা খুলে দিলেন। এন্ডি তার ফোকলা দাতে ফিক
করে হেসে দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। বছর দুয়েক আগে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে কার সাথে মারামারি
করতে গিয়ে ঘুষি খেয়ে দাঁত ভেঙ্গে গেছে। উপরে এসে দেখে পানি গরম হয়ে গেছে। কফির পাউডার ছেড়ে কিছুক্ষণ ঢেকে রাখলেন। দুইটা কাপে নিজের হাতে গুড়া করা কফি
বানিয়ে একটা এন্ডির হাতে দিয়ে বসলেন। আধা
ঘণ্টার মধ্যেই কফি শেষ করে জিনিষ পত্র নামিয়ে লেস্টারের পথে চলল। এন্ডি গাড়ি
চালাচ্ছে আর কথা বলছে। ওর সাথে গাড়িতে উঠলে এই এক সমস্যা, সারাক্ষণ
বকবক করতেই থাকে।
১৯৮।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে লেস্টার এসে পিটারের সাথে দেখা হলো অনেক দিন
পর। পিটার গেট খুলে দাঁড়িয়ে ছিল, রাশেদ সাহেবকে নামিয়ে দিয়ে এন্ডি পিটারকে
হ্যালো বলেই চলে গেল। এন্ডি চলে যাবার পর পিটার রাশেদ সাহেবকে নিয়ে বসার ঘড়ে এসে বললো অনেক দিন পর তোমার সাথে
দেখা হলো, চল আগে খেয়ে নিই তার পর কাজের বিষয় নিয়ে বসব, তোমার জন্য
দেখ কি এনে রেখেছি বলেই ফ্রিজ খুলে দেখাল সাদা ওয়াইন সার্ডনির বোতল।
-এ দিয়ে আমার কি হবে, আমি এসব খাই
না তা কি ভুলে গেছ?
-ও হ্যাঁ তাইতো তাহলে আমি একা খাব? তুমি কি
খাবে বল?
-আমার জন্য একটু ফ্রেশ জুস হলেই হবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে পিজার অর্ডার দেই ওরা এখানে এনে
দিয়ে যাবে ওদেরকে বলে দিলেই পাশের সিনসবারি থেকে জুস নিয়ে আসবে।
-না না পিজা না।
-তাহলে কি? ইটালিয়ান
নাকি চাইনিজ?
-না না ওসব কিছু না, আরে ভাত মাছ
না খেয়ে বাঙ্গালি বাঁচে কি ভাবে?
-তাহলে কি ইন্ডিয়ান?
-হ্যাঁ, এখানে পাশের বেলগ্রেভ
রোডে অনেক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে ওখানে চল, খেয়ে আসি
ইন্ডিয়ান খাবার ডেলিভারি এনে খেলে স্বাদ পাওয়া যায় না।
-বেশ চল।
ঘর বন্ধ করে গেটে তালা দিয়ে মিনিট ১০/১২ হেঁটে বেলগ্রেভ রোডের এক
ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে ঢুকল। এখানে যদিও মাছ পাওয়া যায় না তবে ভাত আর মাংস তো পাবে। রাশেদ সাহেব ভেড়ার মাংস আর ভাতের অর্ডার দিলেন, পিটার দিল
চিকেন, নান রুটি, চিপস আর তার সাথে এক পাইন্ট বিয়ার আর এক গ্লাস
আপেল জুস। খেতে খেতে আলাপ হচ্ছে। পিটার বললো তোমাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে আমি চলে যাব
কাল সকালে আটটায় আসবো, তবে ভেবো ন তোমাকে একজন ভাল সঙ্গী দিয়ে যাব।
রাশেদ সাহেব মনে মনে ভাবছেন এই সঙ্গী আবার কে? এতক্ষণ জানতাম
আমি একাই থাকবো। জিজ্ঞেস করলেন-
-সঙ্গী আবার কে?
-আছে, টমি আছে, টমি থাকবে
তোমার সাথে, আশা করি টমির সাথে তোমার সময় ভালোই কাটবে।
একটু অবাক হয়ে বললেন-
-টমি! কই দেখলাম না তো? এই নামে কেও
আছে আমাদের কোম্পানিতে তাও তো শুনিনি।
-আছে ওর ঘরেই আছে।
আচ্ছা ঠিক আছে দেখা যাক, গেলেই দেখা হবে। খেয়ে দেয়ে চলে এলো।
কন্ট্রোল রুমে এসে সব কিছু দেখিয়ে দিয়ে বললো এইতো দেখলে আর যা আছে তা টমি দেখিয়ে
দিবে। ওহ! চল তোমার থাকার ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি। থাকার ঘর দেখিয়ে দিয়ে বললো চল এবার
টমির সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।
১৯৯।
কন্ট্রোল রুমের পাশে একটা ছোট ঘর খুলে ও ঢুকল রাশেদ সাহেব ওর পিছনে।
ঢুকেই দেখলেন গলায় শিকল বাঁধা বিশাল এক এলসেসিয়ান পিছনের দুই পায়ের উপর বসে আছে
সামনের পা দুটি সামনে বিছানো। ওজন সত্তর কেজির কম হবে না। আস্ত এক নেকড়ে বাঘের মত
মনে হলো। রাশেদ সাহেবকে দেখে ঝট করে উঠে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ঘেউ করে উঠলো। এই
প্রাণীর প্রতি এমনিতে ছোট বেলা থেকেই রাশেদ সাহেবের ভয়। যখন ক্লাস সেভেন থেকে এইটে
উঠে তখন এক জায়গায় পরীক্ষা দিয়েছিল তাতে ভালোই হয়েছিলো বলে পরবর্তীতে ভাইভার জন্য
যেদিন যেতে বলেছে সেই দিন ভোর বেলা উঠে বাসার পিছনে পাইপ দিয়ে সবজি বাগানে পানি
দিচ্ছিল আর এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে এক পাগলা কুকুর পিছনে থেকে এসেই বাম হাতের
কব্জি কামড়ে ধরল।
ভয়ে আর ব্যথায় চিৎকার করতেই মা এসে দেখে হতভম্ব।
তাড়াতাড়ি হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে বাগানে পানি দেবার পাইপের এক মাথা ধরে পটা পট
কয়েক ঘা দিতেই হাত ছেড়ে যে পথে এসেছিলো সেই পথে পালিয়ে গেল কিন্তু যাবার আগে রাশেদ
সাহেবের হাতের কব্জির একটা রগ কেটে দিয়ে গেল। হাত বেয়ে সমানে রক্ত পড়ছে। মা তাকে
টেনে ঘরে এনেই মগে ডেটল গুলিয়ে হাতে ঢেলে দিলেন। একটু পরিষ্কার হলে দেখা গেল তিনটা
দাঁত বিঁধেছে। তার মধ্যে হাতের বুড়ো
আঙ্গুলের উপরে একটা রগ মনে হয় কেটে গেছে বলে এখানকার রক্ত থামছে না। হাতের কাছে যা
ছিল তাই দিয়ে কোন রকম ব্যান্ডেজ করে দিলেন। চেঁচামেচি শুনে বাবা এগিয়ে এসেছেন পাড়া
প্রতিবেশী ও দুই একজন এসেছে। তাদের পরামর্শে বাবা রেডি হয়ে নিলেন। একজন স্কুটার
ডেকে এনেছে তাতে করে হাসপাতালে নিয়ে গেল। তখনো বুড়ো আঙ্গুলের উপরের অংশ থেকে রক্ত বের হচ্ছে। ইমার্জেন্সি ডাক্তার দেখে বললেন এই রগ কেটে গেছে
সেলাই দিতে হবে। সেলাই করে ব্যান্ডেজ করে হাতে আর পেটে ইঞ্জেকশন দিয়ে বলে দিল ১৪
দিনে ১৪ টা ইঞ্জেকশন দিতে হবে। আজ
নিয়ে যান আর কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু
রাশেদ সাহেবের সেই ভাইভা আর দেয়া হলো না। হলে হয়তবা তার জীবন এখন যেরকম চলছে সেরকম
না হয়ে ভিন্নরকম হতে পারতো। এই হচ্ছে ঘটনা, এর পর থেকেই
এই প্রাণীর প্রতি তার অসম্ভব রকমের ভয়।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।