১৯১।
রাশেদ
সাহেব নিউ ক্যাসেলে চলে আসলেন।আসার আগে লন্ডন হয়ে খুকুকে দেখে
এসেছেন। রাসেলের সাথে কথা হয়েছে। আপাতত সাউথ
শিল্ডে ওর ওখানেই উঠবে পরে মিজান যেখানে পাঠায় সেখানে যাবে। কয়েক দিন রাসেলের
বাসায় থাকার পর ডার্লিংটন শহরের কাছে রোজবি নামে এক গ্রামে পাঠাল। এখানে কাজের
নিয়ম কানুন সহ যা যা প্রয়োজন তা মিজান বুঝিয়ে দিয়েছে। চারিদিকে সিসি ক্যামেরা থাকে আর এক
রুমে সেগুলির মনিটর থাকে সেই রুমে বসে মনিটরের দিকে লক্ষ রাখা। কাজ তেমন কোন কঠিন কিছু নয়। সপ্তাহ খানিক
থাকার পর যখন কাজ কর্ম আয়ত্তে নিতে পেরেছে তখন রোজবি থেকে লিডস এ পাঠিয়ে দিল।
এভাবে এ সপ্তাহে লিডস তার পরের মাসে আবার নরউইচ, রচডেল, নরমেনটন আবার প্লিমাউথ এমন করে
সমস্ত ব্রিটেন ঘুরে কাজ করতে করতে রাশেদ সাহেবের দিন, সপ্তাহ, মাস এবং বছর চলে যায়। ব্রিটেনের
আনাচে কানাচে গ্রাম গঞ্জে ঘুরে দেখতে পারছে। ওখানেই রান্না করা এবং থাকা খাওয়া।
তবে অসুবিধা হলো এমন সব অনেক জায়গায় উপমহাদেশীয় কোন দোকান নেই বলে ইংলিশ সুপার স্টোর টেসকো
বা সমার ফিল্ডে কিংবা সিনসবারিতে যা পাওয়া যায় তাই খেতে হয়। হলুদ, মরিচ পাওয়া যায় না, হালাল মাংস বা মুরগি
কিছুই পাওয়া যায় না তবে আদা রসুন পিঁয়াজ পাওয়া যায়। তাই দিয়েই শুধু সবজি আলু ডিম লবণ দিয়ে সেদ্ধ বা রান্না করে
উপরে একটু গোল মরিচের গুড়া আর ভিনিগার ছিটিয়ে ইংলিশ স্টাইলে খেয়ে দিন কাটাতে
হচ্ছে। মাঝে মাঝে সামুদ্রিক বা এদেশের নদীর মাছ যেমন হেরিং, ট্রাউট, স্যালমন, সার্ডিন লবণ গোল মরিচে
মাখিয়ে ভাজি করেও খেয়েছে। এই সব জায়গাগুলা পরিত্যাক্ত জায়গা বলে থাকার ব্যবস্থা
খুবই বাজে, কোথাও বিজলি নেই, পানি নেই। হিটার নেই। পানি কিনে রান্না, গোসল ধোয়া সব
করতে হয়। বিছানা পত্র নেই বললেই চলে পরিত্যাক্ত বোর্ড বা এমনি কিছু বিছিয়ে রাত
কাটাতে হয়।
এর
মধ্যে প্লিমাউথে থাকা কালীন একদিন মিজান জানাল-
-চাচা
আপনাকে এবার লেস্টার যেতে হবে। ওখানে ইন্ডিয়ান এলাকা কাজেই খাবার কষ্ট হবে না সব
কিছুই পাবেন
-বেশ
যাব, কবে যেতে হবে?
-আগামী
কাল
রাশেদ
সাহেব ভেবে দেখলেন আগামী পরশু ঈদ।
-তাহলে
চাচা, লেস্টার যাবার আগে
আমাকে কয়েক দিনের ছুটি দাও আমি লন্ডন গিয়ে মেয়ের সাথে ঈদ করে পরে জয়েন করি?
-ছুটি
নিবেন? কত দিন থাকতে চান?
-সপ্তাহ
খানিক! অনেক দিনতো হলো, একটু রেস্ট নেয়াও হবে আবার মেয়ের সাথে ঈদটাও করা হবে!
-আচ্ছা
তাহলে তাই করেন। হিসেব করে একটা তারিখ জানিয়ে বললো এই দিন আপনি লেস্টার চলে আসবেন।
কোথায় কি এগুলি আমি পরে জানিয়ে দিব।
-আচ্ছা
ঠিক আছে,
এখান
থেকে কবে যেতে পারব?
-আগামী
কাল দুপুরে রবার্ট আসবে ওকে বুঝিয়ে দিয়ে আপনি চলে যাবেন।
-ভেরি
গুড চাচা।
মিজানের
সাথে কথা শেষ করে খুকুর সাথে আলাপ করলেন। খুকু ভীষণ
খুশি। বিদেশে একা একা ঈদ করতে হবে ভেবে খুব মন খারাপ করে ছিল। বাবা
আসছে শুনে আনন্দে প্রায় নেচে উঠল।
-আব্বু
তুমি কি কি খাবে বল আমি বাজার করে রাখি।
-না
আব্বু তোমাকে কিছু করতে হবে না, তানিমরা রয়েছে ওরা যা করে তাই হবে।
-খুকুর
ফোন রেখে আবার ফিরোজকে, ফিরোজ আমি কাল লন্ডন আসছি।
-তাই
নাকি? ঈদ করতে?
-হ্যাঁ, এখান থেকে লেস্টার
যেতে বললো তাই বললাম তাহলে আমাকে কয়েক দিন ছুটি দাও।
-বেশ
ভাল হয়েছে,
তাহলে
তুমি তিথিকে বলে দাও ও যেন কাল ক্লাস সেরে আমার এখানে চলে আসে, তুমিও গ্লোব রোডে না
গিয়ে এখানে চলে আসবে! এখানেই একসাথে ঈদ করব।
-মন্দ
বলনি, তা করা যায়। একটু ভেবে বললেন,-তাহলে তানিমরা মাইন্ড
করবে না?
-হ্যাঁ
তা করতেই পারে,
তাহলে
তুমি বিকেলে ওখানে চলে যেও।
-হ্যাঁ
এটা ভাল কথা.
আবার
ফিরোজের ফোন রেখে তিথিকে ফিরোজ চাচার বাসায় চলে সতে বললেন।
-না
আব্বু তা কেমন করে হয়? এদিকে
কেয়া চাচী তুমি আসছ শুনে খুব খুশি, তুমি কি কি খেতে পছন্দ কর তার লিস্ট নিয়ে নিয়েছে, কালই হোয়াইট চ্যাপেল
থেকে বাজার করবে, এর
মধ্যে তুমি না আসলে কেমন হয়?
-হ্যাঁ, সকালে ফিরোজের সাথে
নামাজ পড়ব সারাদিন এখানে থেকে পরে বিকেলে ওখানে চলে যাব, কি করব বাবা ফিরোজ আমার বন্ধু
মানুষ ওর কথা না রেখেই বা কেমন হয় আবার তানিমদের সাথে না থাকলেও কেমন হয়, তার চেয়ে এটাই ভাল হয়
না?
-আচ্ছা
ঠিক আছে আমি চাচীকে বুঝিয়ে ম্যানেজ করছি।
১৯২।
কয়েকদিন
আগে মনিকে বলে দিয়েছিলেন এবার হাতে টাকা আছে কাজেই তোমরা সবাই ভাল ভাল পোষাক
কিনবে। এতদিন যা বেতন পেয়েছে তাতে সাধ মিটিয়ে ঈদের বাজার করার উপায় ছিল না। এবার
হয়েছে তাই মেয়েরা যারা ঢাকায় রয়েছে ওরা অনেক দিন থেকেই কোন রকম চালিয়ে আসছে। হাতে
অর্থ না থাকলে কেনাকাটার ব্যবস্থা না থাকলে মন এমনিই বেদনাক্রান্ত ভারাক্রান্ত হয়ে
থাকে। তার থেকে কিছুটা রেহাই পাবার জন্য, যাতে করে মনের এমন গ্লানি কিছুটা দূর করতে পারে তার
ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক টাকা পাঠিয়েছে। লন্ডনে খুকুকেও ঈদের বাজার করার জন্য টাকা
পাঠিয়েছে।
খুকুর
সাথে কথা বলে ঢাকায় মনির সাথে আলাপ করে বলে দিলেন যে ভাবে ওদের জন্য ঈদের বাজার
করতে বলেছিলাম সে ভাবে করেছ?
-হ্যাঁ
ওদের নিয়ে গাউছিয়া গিয়েছিলাম ওখান থেকে ওদের ইচ্ছে মত পোষাকের কাপর কিনেছে, সাথে স্যান্ডেল হাতের
চুরি সব কিছুই কিনে দিয়েছি।
-তোমার
জন্য কি কিনেছ?
-আমার
আবার কি কিনবো! আমি কিছু নিতে চাইনি কিন্তু ওদের জ্বালায় না কিনে পারিনি, একটা জামদানি কিনে
দিয়েছে। মাঝু বলে আমরা পরব আর তুমি পরবে না এটা কি হয়? এতে কি আমরা কোন আনন্দ পাব? তারপরে আবার বড় আপু
নেই, আব্বু নেই।
-বাহ!
বেশ ভাল করেছ।
-তুমি
কিছু কিনেছ?
-কি
যে বল, আমি যেখানে থাকি, যে ভাবে থাকি এতে কি
এসব মানায়?
তোমরা
পরবে আমি মনে মনে তোমাদের সাজ পোষাকের কথা ভেবে কল্পনা করব, স্বপ্ন দেখব এতেই আমি
সুখী।
-তুমি
এ ভাবে বলছ কেন?
শুনতে
খুব কষ্ট হয়।
-কেন? কষ্ট হবে কেন? মনকে এভাবেই মানিয়ে
নাও। এ ভাবেই চলছে কতগুলি বছর ধরে। আমি মানিয়ে নিয়েছি তুমি কেন পারবে না?
-মেয়েরা
বলছে বাবার টাকায় কেনা কাপর পরলেই কি বাবার আদর পাওয়া যায়? আব্বুর বুকের আদর পাওয়া যায়?
রাশেদ
সাহেব সব জিনিস পত্র গুছিয়ে রাখলেন যেন সকালে রবার্ট এলে দেরি না করে সরাসরি কোচ
স্টেশনে যেতে পারেন।
পরদিন
সকাল দশটায় রবার্ট এসে হাজির।
-হাই
রাশেদ!
-আমি
অপেক্ষা করছিলাম তুমি কখন আসবে। চল তোমাকে সব কিছু দেখিয়ে দিচ্ছি।
রবার্টকে
সব বুঝিয়ে দিয়ে,
-তাহলে
গুড বাই!
-ওকে
গুড বাই,
সি ইউ
লেটার।
১৯৩।
লন্ডন
পৌঁছে ফিরোজের বাসায় গিয়ে দেখে ভাবীমহা হুলস্থূল করে রেখেছে। আজই সন্ধ্যা থেকে
ঈদের রান্না বান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সন্ধ্যায় রাজকীয় ইফতারের ব্যবস্থা করেছে। দেশিয়
অনেক কিছু করেছেই তার সাথে বিভিন্ন রকমের আরবি কাবাব, ইংলিশ পিজা, ডাম্পলিং, এবং আঙ্গুর পাতায়
মোড়ানো একরকম পুর দেয়া বেশ মজার একটা খাবার সাথে আবার ইতালিয়ান পাস্তাও করেছে।
-আচ্ছা
ভাবী আমার জন্য এই ব্যবস্থা করেছেন দেখে ভীষণ ভাল লাগছে কিন্তু আপনি আমাকে একটা
কথা বলেন তো।
-কি
কথা ভাই?
-যদি
আপনি ব্রিটেনের রানীকে নেমন্তন্ন করতেন তাহলে আর কি করতেন?
-What
is nemotonno?
-ও!
সরি ভাবী নেমন্তন্ন মানে ইনভাইট করা।
-ওআচ্ছা, না ভাই আপনি এতদিন এত
কষ্ট করেছেন তাই আপনার বন্ধু বলছিল ওর জন্য ভাল কিছু করবে। -আপনি বলেন কি কি করব, আপনার কি খেতে ইচ্ছে
করে?
-ভাবী, আপনি যা করছেন এতেই
আমি অবাক হচ্ছি,
কাজেই আর
কি বলব? এর মধ্যেই আমার
পছন্দের সব আছে।
-তবুও
কিছু বলেন।
-না ভাবী
আর কিচ্ছু বলার নেই, বিরিয়ানি
করছেন তো?
-হ্যাঁ
নামাজ পড়ে এসে বিরিয়ানি খাবেন।
সত্যিই
এই সারাটা মাস ধরে রোজা রেখেছে কিন্তু কোন দিন ইংলিশ স্টোরে যা পাওয়া গেছে সে সব
ছাড়া এমন ধরনের ইফতারের মুখ দেখেনি। কেক, স্যান্ডউইচ, কোক, জুস, কাস্টার্ড, ফলমূল এই ছিল নিয়মিত ইফতারির মেনু। ইফতারির
পরেই চায়ের কাপ হাতে ফুফু আম্মার সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করলেন ওদিকে ভাবী শুরু করল ঈদের
রান্না। তিথিও চাচীকে সাহায্য করছিল। ফুফু আম্মা এসে কিচেনের একটা চেয়ারে বসে ওদের
কাণ্ড কারখানা দেখছিল। এসব দেখে রাশেদ সাহেবের দেশের বাড়ির কথা মনে হলো। ফিরোজের
সাথে এই নিয়ে অনেকক্ষণ আলাপ হলো।
-জান
ফিরোজ, আমাদের বাড়িতেও সেই
ছোট বেলা থেকে মাকে দেখেছি ঈদের আগের সন্ধ্যা থেকেই রান্না শুরু করতে তিথির মাও
তাই করে।
-হ্যাঁ
মাও এভাবেই শেলিকে শিখিয়েছে
ফিরোজ সোহাগ
করে মাঝে মাঝে শেফালি না বলে শেলি বলে ডাকে।
-সত্যিই
ফিরোজ এটা হবে আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঈদ, এই দিনের কথা আমার অনন্ত কাল ধরে
মনে থাকবে।
-আমারও
মনে থাকবে,
আমিই কি
এখানে তোমার মত এমন ঘনিষ্ঠ জন কাওকে পেয়েছি?
একটু
পরে পরেই ফিরোজ দুই কাপ করে চা এনে এক কাপ বন্ধুর দিকে এগিয়ে আর এক কাপ নিজে
নিচ্ছে। অনেকদিন পরে এমন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে আড্ডায় বসেছে, তারপরে কাল একসাথে ঈদ করবে তার
মনেও অনেক আনন্দ!
-এবার
বল তিথির বিয়ের ব্যাপারে কি চিন্তা করেছ?
-কি
আবার করব! ওর মায়ের সাথে আলাপ করেছি সে বললো ফিরোজ ভাই যা ভাল মনে করে তাই করবে
-তাহলে
কাল ছেলেকে এখানে আসতে বলি? দেখাশোনা কর!
-হ্যাঁ
বলতে পার।
রাশেদ
সাহেব ফোন করে কেয়া আর তানিমকে জানিয়ে দিয়েছে। কেয়া বললো,
-না
ভাইয়া ঠিকই আছে,
আপনার
ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাকে কি আর এভয়েড করা যায়, তবে আমরা অনেক প্ল্যান করে ফেলেছিলাম। যাক তবুও আসছেন এতেই
হবে।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।